জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন হওয়ার আগে সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ দেখছে না জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এ ছাড়া নির্বাচন ঘিরে অন্তর্বর্তী সরকারের বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদ পুরো পরিবর্তনের সুযোগ নেই বলেও মনে করে দলটি। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির এই অবস্থান তুলে ধরেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
গতকাল বিকেল ৫টার দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে যমুনায় যান এনসিপির চার নেতা। নাহিদ ছাড়াও প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ।
এর আগে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার ও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করার দাবি জানানোর পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নেওয়ার এবং সরকারের মধ্যে দলীয় লোক থাকলে তাদের অপসারণের দাবি জানানো হয়।
গতকাল এ প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম জানান, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন হওয়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সুযোগ নেই বলে তারা মনে করেন। তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টাই পুরা জুলাই সনদের আওতাভুক্ত আছে। যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণভোটের আগেই হয়, সেটাকে বাস্তবায়ন করতে চান, তাহলে নির্বাচন কমিশনও পুনর্গঠন করতে হবে জুলাই সনদের আইন অনুযায়ী বা সেখানকার ঐকমত্য অনুযায়ী। ফলে এই বিষয়গুলো আসলে যারা বলছেন, তারা কোন বিবেচনায় বলছেন, কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বলছেন, এটা আসলে সন্দেহজনক।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, উপদেষ্টা পরিষদের নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করা লাগবে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য। সে দাবির সঙ্গে ভিন্নমত নেই। কিন্তু এ উপদেষ্টা পরিষদ পুরো পরিবর্তন করতে হবে, এটার আসলে সুযোগ নেই।’
জুলাই সনদে স্বাক্ষর প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম বলেন, যেহেতু জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি সেখানে অংশগ্রহণ করেনি, ফলে আমরা আমাদের অবস্থান সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। ঐকমত্য কমিশনের কাছেও আমরা অবস্থান তুলে ধরেছি। আমরা সে কথাগুলো পুনর্ব্যক্ত করেছি যে, জুলাই সনদের শুধু কাগজে মূল্যে আমরা বিশ্বাসী নই। ফলে জুলাই সনদ বাস্তবায়নটা কীভাবে হবে সে সম্পর্কে নিশ্চয়তা পাওয়ার পর আমরা স্বাক্ষর করব। সেক্ষেত্রে জুলাই সনদে আমরা একটি সাংবিধানিক আদেশের কথা বলছি। যে আদেশটা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান হিসেবে তিনি জারি করবেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের যে সার্বভৌম ক্ষমতা, সেটার একমাত্র বৈধতা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের আছে, সেটা প্রেসিডেন্ট চুপ্পুর নেই। এই সাংবিধানিক আদেশের আইনি এবং রাজনৈতিক কারণ আমরা তার (প্রধান উপদেষ্টার) সামনে তুলে ধরেছি। দ্বিতীয়ত, নোট অব ডিসেন্টের বিষয়টা আমরা বলেছি। নোট অব ডিসেন্টের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। সবাই এ বিষয়গুলোতে একমত হয়েছেন।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ যে বিষয়গুলোর ওপর রচিত হয়েছে সেটাই পুরোটা গণভোটে যাবে এবং গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদিত হলে পরবর্তী সংসদের একটা ক্ষমতা থাকবে, যার ফলে তারা একটি সংস্কারকৃত নতুন সংবিধান তৈরি করবেন। এই পুরা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যদি ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ দেয় এবং সরকার সে অনুযায়ী কী সিদ্ধান্ত নেয় তার ওপর নির্ভর করে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি বিবেচনা করব। সরকারের কাছে আমরা আমাদের এ দাবিগুলো জানিয়েছি এবং দাবিগুলো যাতে বিবেচনা করা হয় এবং সরকার যাতে সে পথে যৌক্তিকভাবে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে এগোয় সে বিষয়ে আমরা জোর দাবি জানিয়েছি।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে এনসিপি নির্বাচন কমিশন নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশনের বর্তমান আচরণ আমাদের কাছে নিরপেক্ষ মনে হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যেভাবে কার্যক্রম করার কথা, সেটা করছে না। কিছু দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা যাচ্ছে এবং কিছু দলের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ তারা করছে। নির্বাচন কমিশন নিয়ে এই পুরো বিষয়টা আমরা বলেছি।
তিনি বলেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন যদি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে না পারে, এর দায় সরকারের ওপরও আসবে। ফলে আমরা সরকারকে সে বিষয়টি অবহিত করেছি এবং আমরা মনে করি নির্বাচন কমিশন এ মুহূর্তে পুনর্গঠন হওয়া প্রয়োজন।
উপদেষ্টা পরিষদের বিষয়েও বক্তব্য দিয়ে এসেছেন জানিয়ে নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের পদায়ন দেওয়া হচ্ছে, সেক্ষেত্রে যোগ্যতার ভিত্তিতে হচ্ছে কি না—বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি, প্রশাসনে বিভিন্ন ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে এসপি, ডিসির জন্য তালিকা করে দিচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদের ভেতর থেকে সেই দলগুলোকে সহায়তা করছে। এভাবে চললে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দলীয় পক্ষপাতের বিষয়টি যেন প্রধান উপদেষ্টা দেখেন, সে বিষয়টিও আমরা জানিয়েছি।
মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সেনা সদস্যদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা এটাকে সাধুবাদ জানিয়েছি। সরকার এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি আমরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি যে, ন্যায়বিচারের একটি ধাপ আমরা এগোচ্ছি। কিন্তু এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি সারা দেশে যে মামলা হয়েছে, জুলাই শহীদ পরিবারদের পক্ষ থেকে আহতদের পক্ষ থেকে, সেই মামলাগুলোর বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ কী? আমরা দেখতে পাচ্ছি, জামিনে আসামিরা ছাড়া পাচ্ছেন এবং তারা শহীদ পরিবার এবং আহতদের হুমকি দিচ্ছেন। সেই জায়গায় শহীদ পরিবার, আহতদের নিরাপত্তা এবং বিচারের একটা রোডম্যাপ আমরা চেয়েছি—নির্বাচনের আগে যাতে বিচারের একটা রোডম্যাপ প্রকাশ করা হয়। প্রায় ৮ শতাধিক মামলার কথা উল্লেখ করে নাহিদ জানান, এই মামলাগুলোর এখন অবস্থা কী এবং সেগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, কতদিনের মধ্যে এবং কোন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে সে বিষয়ে রোডম্যাপ চাওয়া হয়েছে।